সন্তানহীন এক জার্মান পরিবারের শেষ পরিণতির কাহিনী
একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখা!!
ইস্টার এর বন্ধে এক দেশী বড় ভাই এর বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। ইফতার আর মাগরিবের নামাজ শেষ করলাম ৮:৪৫ এ। তারপর তারাবী শেষ করে রাত ১১:৩০ থেকে বন্ধু-বান্ধবসহ আড্ডা দিচ্ছিলাম। ভাবলাম একেবারে সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকবো। এই পর্যায়ে এক বড় ভাইয়ের স্ত্রী ওনার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন একটা সন্তানহীন জার্মান পরিবার নিয়ে। ওই ভাবীর নাম দিলাম সুমি (আসল নামটি ওনার অনুরোধেই গোপন রাখলাম)।
সুমি ভাবি এক সময় তার এক জার্মান বান্ধবীর একটা সবজি দোকানে যেটা উইকেন্ড এ বিশেষ কিছু জায়গায় বসে, ওটাতে কাজ করতেন। কাজের সুবাদে ওনার দোকানে নিয়মিত আসা এক জার্মান দম্পত্তির সঙ্গে খুব ভালো খাতির হয়ে যায়। জার্মান ভদ্রলোক এক সময় আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করতো। আর তার স্ত্রী জব করতেন একজন ব্যাংকার হিসেবে। দুইজন তখন বুড়া-বুড়ী। তাদের নেই কোন সন্তান। ওই বুড়ি একদিন ওই ভাবীকে ওনার বাসায় যেতে দাওয়াত দিলো। বললো তার কথা বলার কেউ নেই। ভাবি একদিন ওনার স্বামী-সন্তান সহ গেলেন। ওই বুড়ি এবং বুড়া তাদেরকে অনেক খাতির যত্ন করলো। ভাবীর ছেলে-মেয়েদের অনেক গিফট দিলো।
ওই জার্মান দম্পত্তি অনেক বড় লোক। একটা বিশাল ভিলা টাইপ বাড়ী যেটা কিনা স্টুটগার্ট এর মতো অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। আরো অনেকগুলি বাড়ি-ঘরের মালিক তারা। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তাদের কাছে তাদের দেখার মতো কেউ নেই।
ওই বাংলাদেশী ভাবী নিয়মিত বুড়া-বুড়ির বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে লাগলো। তারাও খুশি। প্রতিবার তারা অনেক কিছু গিফট করে।
বুড়া-বুড়ি ওই ভাবীদের জিজ্ঞেস করতো যে, তারা বাংলাদেশে চলে যাবে কিনা একেবারে কোনো দিন। ভাবিরা বলতো, না, যাবে না। এই উত্তর শুনে বুড়া-বুড়ি খুব খুশি হতো। বলতো, তোমরা আমাদের কোনো দিন ভুলে যেও না। আমাদের খোঁজ নিও এখনকার মতো সব সময়।
বুড়ার বিদায়:
বুড়ার পিঠে বেশ ব্যাথা হতো। আস্তে আস্তে ওই ব্যাথা এবং আরো অন্যান্য কিছু রোগের জন্যে বুড়া অনেক বেশি কাহিল হয়ে পড়লো। একটা সময় ব্যাথা অসহ্য আকার ধারণ করলো। অবশেষে বুড়াটি হাসপাতাল এ ভর্তি হলো। এক সময় বুড়া মরে যাবার জন্যে অনুনয় বিনয় করতে থাকলো। বুড়া চাইতো না বুড়ি হাসপাতাল এ আসুক নিয়মিত এবং বুড়ার এই কষ্টটা দেখুক। কি যে ভালোবাসা তাদের মধ্যে! এক সময় বুড়ি ও সম্মতি দিলো বুড়াকে মেরে ফেলার জন্যে। যেদিন শেষ দেখা হলো ওই দিন ওই বাংলাদেশী ভাবি বুড়িকে হাসপাতাল এ নিয়ে গিয়েছিল। ওই দিন বুড়া-বুড়ির অঝোর কান্না ভাবীটিকেও অনেক বিচলিত করে দিয়েছিলো। বুড়া ওই দিন ভাবীকে হাত ধরে অনুরোধ করেছিল যে, বুড়া মারা যাবার পর যেন উনি বুড়িকে একটু দেখে রাখে। ভাবি কথা দিয়েছিলো, রাখবে!
একটা কথা এখানে বলে রাখি। জার্মানিতে অনেক বাঙালি আছেন, বিশেষ করে যারা একটু পুরোনো, তারা অনেক সন্তানহীন বুড়া-বুড়িকে দেখা শোনার বিনিময়ে ওদের যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হয়েছে তাদের মৃত্যুর পর। এটা জার্মানিতে খুব রেয়ার কেস না। অনেক অমন ঘটনা শোনা যায়। তবে এখনকার দিনে অমন বুড়া-বুড়ি একটু কম।
এর দুই দিন পরে বুড়া মারা গেলো। তার লাশ কবরস্থানের হিমঘরে রাখা হলো। একটা কবর খোঁড়া হলো, যেটা কিনা ওই বুড়া নিজে কিনে রেখেছিল। তাদের নিকটাত্মীয় এবং বন্ধু-বান্ধব সবাই এলো ওখানে। সবাই দাঁড়ালো, একটা করুন বাঁশি বাজালো। আরো কিছু ওদের ধর্মীয় দোআ দরূদ পড়লো। তারপর কবরে নিয়ে সমাধিস্থ করলো।
সমাধি করে সবাই চলে গেলো একটি রেস্টুরেন্ট এ। ওখানে সবাই ভালো মন্দ গল্প করলো। বুড়িকে শান্তনা দিলো। ওই বুড়িকে ভাবি বাসায় পৌছিয়ে দিয়ে, নিজের বাসায় চলে গেলো।
পাশের এক প্রতিবেশী ভাবীদের ওই বাসায় যাওয়া-আসা পর্যবেক্ষণ করলো। ওই প্রতিবেশী বুঝতে পারলো যে, এই বুড়া -বুড়ির বিশাল সম্পত্তি হয়তোবা ভাবীরাই পেতে যাচ্ছে।
ভাবি এর পরের সপ্তাহে যখন বুড়ির বাসায় যাবার জন্যে ফোন দিলো তখন ফোন ধরলো ওই প্রতিবেশী। ওই প্রতিবেশী বললো যে, বুড়ি এখন ঘুমাচ্ছে, পরে যেন ফোন দেয়। এরপর কয়েকবার ফোন করেও আর বুড়িকে পেলোনা ওই ভাবি। প্রতিবার ওই প্রতিবেশী ফোন ধরে। একদিন বুড়ি ফোন দিলো ওই প্রতিবেশীকে দিয়ে ভাবীকে। বললো বাসায় যেতে। ভাবি বাসায় যেয়ে দেখে ওই বুড়ি ঘুমিয়ে আছে। আর বাসায় ওই প্রতিবেশী। অনেক্ষন বসে থেকেও বুড়ি এলো না। ভাবি চলে এল, কারণ ওই প্রতিবেশী ঠিক চাচ্ছিলোনা ভাবি থাকুক। আসলে হতে পারে, ওই প্রতিবেশী ইচ্ছে করে কোনো ঘুমের ঔষুধ খেয়ে দিয়েছিলো যাতে বুড়ি ঘুমায় বেশি।
ভাবি এর পর ১০ টি বছর আর যায়নি ওই বুড়ির কাছে, অভিমানে। একদিন একটা চিঠি পেলো বুড়ির কাছ থেকে। বুড়ি কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছে ওই চিঠিটি। ওখানে ভাবীকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা ব্যক্ত করা। বুড়ি নাকি আর কথা বলতে পারেনা, এই জন্যে চিঠিটি লিখা। ওই চিঠিটি ভাবি দেখলো এক সপ্তাহ পরে। পেয়েই ছুটে গেলো বুড়ির বাড়িতে। গিয়ে দেখলো বুড়ির লাশ নিয়ে বের হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ভাবীর ছিলোনা আর কোন শক্তি কিছু বলার, চেয়ে চেয়ে দেখলো। মনের অজান্তে শুধু বের হয়ে গেলো, দু-ফোঁটা চোখের জল। আসলে সন্তান-হীন বাবা-মা দের জীবনের শেষ মুহূর্তে কোনো আপনজন কাছে না পাওয়ার মর্মান্তিক বেদনার অমন কথা অনেক শোনা যায় জার্মানিতে।
©️ Dr. MK Kabir
We are doing too much hard work when we are young, but we don't think what will happen when we are old, so make a beautiful family before you die.